tea advertisement

বিজ্ঞাপনে চা

বোরোলিনের মত এক পেয়ালা চা বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ অব্দে চিনা সম্রাট শেন নুং চায়ের আবিষ্কার করেন। এরপর ব্রিটিশদের হাত ধরে বাণিজ্যিকভাবে ভারতে চায়ের চাষ শুরু হয়। ১৮৫৫ সালে অবিভক্ত ভারতের সিলেটে চায়ের গাছ খুঁজে পাওয়া যায়। ক্রমে এ দেশে চায়ের ব্যাপক প্রসার ঘটে আর বাংলায় চা তো বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাদের চা চাই, দুপুরে অপিসে কাজের ফাঁকে এক কাপ চা হলে ভাল, বিকেলে সূর্যদেব পশ্চিমে ঢোলে পড়লে প্রাণটা চা চা করে ওঠে, বাড়ি ফিরে বৈঠকখানার আরামকেদারায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে এক কাপ পেলে ক্লান্তি দূর হয়। এছাড়া চায়ের টেবিলে তর্কের তুফান তুলতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। বর্তমান সময় শহর এবং শহরতলির অলিতে গলিতে নানান ধরণের কাফে গজিয়ে উঠলেও বঙ্গবাসীর কাছে চায়ের কদর এতটুকু কমেনি! আর সেই জন্যই বোধহয় চা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনে এসেছে নানান বিবর্তন। বিখ্যাত চিত্রশিল্পীরা তাঁদের তুলির যাদুতে সৃষ্টি করেছেন চা বিজ্ঞাপনের নিত্যনতুন আঙ্গিক। অন্যদিকে শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ক্রীড়াজগত এবং চলচ্চিত্র জগতের নামি-দামি ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছেন চায়ের বিজ্ঞাপনে। অতীতদিনের পত্র-পত্রিকার পাতা ওল্টালে চোখে পড়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা, সুরশিল্পী তিমিরবরণ, ক্রিকেট খেলোয়াড় ভিনু মানকার প্রমুখ চায়ের গুণগান করে বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছিলেন। প্রখ্যাত মানুষদের তালিকা কিন্ত এখানেই শেষ নয়, চায়ের বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে সঙ্গীতশিল্পী কুন্দনলাল সায়গল, বিশিষ্ট শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী বিদুষী হীরাবাঈ বোর্ডেকর, অভিনেত্রী যমুনা বড়ুয়া, ছায়া দেবী, এভারেস্ট বিজয়ী তেঞ্জিঙ্গিং নর্গে প্রমুখের প্রশংসাসূচক বাক্য। এর বাইরে লোপচু টি, ব্রুক বন্ড, চীনের কোয়াঙ টি, লিপটন টির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংবাদপত্র এবং পত্র-পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। এক সময় দেখা যেত কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের সুবোধ ব্রাদার্সের সামনে চা কেনার জন্য অপিসফেরত চা অনুরাগীদের বিরাট লাইন। অন্যদিকে লালবাজার অঞ্চলের ধ্রুব টি কোম্পানির চায়েরও ভাল চাহিদা ছিল এবং এখনও আছে। দক্ষিণ কলকাতার লেক মার্কেট সংলগ্ন সুইট ভ্যালির দোকানেরও একটা অভিযাত্য ছিল। সেখানকার বৈচিত্রময় ফ্লেভারের জন্য বহু চাপ্রেমীরা সেখানেও ভীড় করতেন।

এবারে একটু দেখা যাক যে চায়ের গুণ সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কী বলেছেন।

চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম কিংবদন্তী অভিনেত্রী ছায়া দেবী একটি বিজ্ঞাপনে বলেছিলেন, ‘তৃষ্ণার সময় এক পেয়ালা চা খেয়ে আমি খুবই তৃপ্তি পাই। তাছাড়া চা স্নায়ুগুলিকেও স্নিগ্ধ করে। আবেগময় কোনঅভিনয় করার পরে এক পেয়ালা চায়ের মত আর কিছুই আমার এত ভালো লাগে না।’

tea-adv

বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা সেন্ট্রাল টি বোর্ড প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপনের জন্য লেখেন, ‘আমি রোজ চা খাই, দিনে অন্তত দু’বার করে। চা পানে স্বাস্থ্যহানি হয় বলে আমি জানিনে। বরং বরাবর দেখেছি সকালবেলা এক কাপ চা খাওয়ার পর দেহ-মনের জড়তা দূর হয়ে যায় এবং কাজে বেশ উৎসাহ আসে।’ আরও একটি বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই নিউ থিয়েটার্স-র বিখ্যাত চিত্র-তারকা যমুনা বড়ুয়া বলেছিলেন, ‘এক পেয়ালা চায়ের মত এমন তাজা করা পানীয় আর কিছুই নেই। চা সত্যিই মন প্রফুল্ল করে।’

tmir-baran tea adv

সংগীত জগতের প্রখ্যাত শিল্পী তিমিরবরণ চা সমন্ধে ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ড প্রচারিত বিজ্ঞাপনে লেখেন, ‘কল্পনার তারে যে নব নব সুরের অস্পষ্ট গুঞ্জন ধ্বনি শুনি, তাকে যন্ত্রের তারে বেঁধে পরিপূর্ণ রূপে ঐকতানের ছন্দে ঝঙ্গকৃত করে তুলতে চা আমাকে অনেকখানি প্রেরণা দেয়।’

চা সম্পর্কে এইসব বিশিষ্ট মানুষদের বিজ্ঞাপন পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে বাঙালির জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথ চা নিয়ে গান লিখলেও কখনোই চায়ের জন্য বিজ্ঞাপন করেননি কেন! এরকম মনে হওয়ার কারণ তিনি বিচিত্র সব পণ্যের একাধিক বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত চায়ের কোনও বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনি যেখানে বিশ্বকবি কিছু লিখেছেন বা বলেছেন।

কিন্তু চায়ের বিষয়ে গান রচনা করেছেন। সেই গান শান্তিনিকেতনের চা চক্রে গীত হয়েছে, ‘এল চিন গগন হতে পূর্ব পবন স্রোতে শ্যামল রসঘন পুঞ্জ’ ভাবতে অবাক লাগে যে এহেন গানের রচয়িতাকে কেন চা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের জন্য কে অনুরোধ করেননি!

tea advertisement

অনেক খোঁজ খবর করে জানা গেল যে বিশ্বভারতী পত্রিকায় এ টস এন্ড সন্স রবীন্দ্রনাথের গানের দুটি লাইন এবং কবির ছবি সহ একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। বিজ্ঞাপনে লেখা রয়েছে, ‘চা স্পৃহ চঞ্চল চাতক দল চল চল হে…’ সঙ্গে কবির ছবি। এই একটি বিজ্ঞাপন ছাড়া চা সংক্রান্ত রবীন্দ্রনাথের আর কোনও বিজ্ঞাপন আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

সত্যজিৎ জায়া বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে এক সময় রায়মশাইও নাকি ঠিক করেছিলেন চায়ের বিজ্ঞাপন করবেন। লিপটন কোম্পানি থেকে তাঁর কাছে প্রস্তাব করা হয় চায়ের জন্য বিজ্ঞাপন করার জন্য, কোম্পানি থেকে সত্যজিৎ রায় এবং বিজয়া রায়কে কাটমান্ডুতে শুটিং-এর জন্য নিয়েও যায় কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে পুত্র সন্দীপ রায়ের আপত্তিতে এই বিশেষ বিজ্ঞাপনের কাজটি আর এগোয়নি। ওই সময় বিশিষ্ট স্থিরচিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষ বেশ কিছু ছবিও তোলেন কিন্তু যেহেতু কাজটি সম্পূর্ণ হয়নি, তাই রায়বাড়ি থেকে নিমাইবাবুকে বারণ করে দেওয়া হয় চা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের জন্য গৃহীত কোনও ছবি যেন কোনওভাবেই বাইরে প্রকাশিত না হয়। সাবধানতা অবলম্বন করলেও একাধিক ছবি প্রকাশ্যে এসে পড়ে!

brook bond tea

বর্তমানে কফির যেমন রমরমা, অতীতে কিন্তু চায়ের থেকে জনপ্রিয় পানীয় আর কিছু ছিল কিনা জানি না। ফার্স্ট প্লাস, ফ্লাওয়ার অরেঞ্জ পিকো, রোস্টেড টি, গ্রীন টি, এখন চায়ের কত রকমফের! ছোটবেলায় দার্জিলিং টির চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। স্বাদে ও গন্ধে সেই চা অতুলনীয় ছিল এবং আজও আছে।

অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতের ‘নীলগিরি টি’ স্বাদে এবং গন্ধে কিছু কম যায় না। সেই সব চায়ের বিজ্ঞাপন নিয়ে পরে আরও বিশদে আলোচনা করা যাবে।